পাকিস্তানিরা যখন নিশ্চিত পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে
ঠিক তখন নিকৃষ্ট একটা পথ বেছে নিয়েছিলো, যা মানব ইতিহাসে আর দ্বিতীয়বার ঘটেনি। মানুষ অনেকটা নিচে নামতে পারে কিন্তু পাকিস্তানিদের মত না।
বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঠিক দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বাধীন বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এই বুদ্ধিজীবী হত্যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা লাভ করতে যাওয়া একটি জাতিকে মেধাশূন্য করা।
জাতির যে সূর্য সন্তানদের আমরা হারিয়েছি সে ক্ষতি আজও কাঁটিয়ে উঠতে পারিনি। “মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী” এই পিচাশের কর্মকাণ্ডে আমাদের দেশের মানুষ সত্যিকারের স্বাধীনতা কখনোই ভোগ করতে পারেনি। মেধাশূন্য জাতি মিলে আরো শূন্যতা তৈরী করেছে। স্বাধীনের পরে দেশে পাকিস্তানের সমর্থন আরো বেড়েছে।
১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা গেছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন। প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাপিডিয়ায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে সংখ্যা দেয়া হয়েছে সে অনুযায়ী একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ শিক্ষাবিদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিত্সক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী।
এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের গোটা সময়টায় বিভিন্ন জেলা শহরে দেশীয় অনুচরদের সহায়তায় হত্যা করা হয় বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে।
২৫ মার্চে যে হত্যাযজ্ঞ চলেছিল তা সুনির্দিষ্ট ছিল না। হানাদার বাহিনীর প্রথম আক্রমনের লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কারন তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঙালির জাতীয়তাবাদের মূলকেন্দ্র বলে বিবেচনা করত। তাই শিক্ষকদের মাঝে পরিচিত যাদের পেয়েছে সামনে তাকেই হত্যা করেছে। তখনই বন্ধ হয়ে যায় ঢাবি। এরপর টিক্কা খান ঢাবি খুলে দেন ২ জুলাই, ১৯৭১। সব শিক্ষককে তাদের কাজ শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই ঘোষনার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল দুইটি; এক, বহির্বিশ্বে প্রচার করা যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক, দুই, পাকিস্তান পন্থি ছাত্র ও শিক্ষকদের একত্রিত করা। তারা রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনকে ঢাকা নিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরি তখন প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করছিলেন।
সেদিন থেকেই ঢাকার নবাব আবদুল গনি রোডের একটি বাড়িতে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নামের লিস্ট করা শুরু হয় কিছু পাকিস্তান পন্থি শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। সেই সাথে পাকিস্তানপন্থি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের অত্যন্ত গোপনে হিটলারের গোস্টাপো বাহিনীর মত ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয়। এই দলটিই আলবদর। একটি জাতিকে মেধাশুন্য করার ইতিহাসের সবচাইতে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র শুরু হয় সেই জাতির শিক্ষিতদের একটা অংশের সহায়তায়। এই বাহিনীর সদস্যরাই বেরিয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে বুদ্ধিজীবি হত্যায়। একে একে খুঁজে হত্যা করতে থাকে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে এই আলবদর বাহিনীর কথা কেউ জানত না এমনকি ভারতীয় গোয়েন্দারাও না।
আলবদরের প্রত্যক্ষ মদতেই ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর একে একে হত্যা করা হয় আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, যারা স্বাধীন নতুন বাংলাদেশকে গড়তে অবদান রাখতে পারতেন। দেশের জন্য, জাতির জন্য ভাবতে গিয়ে যারা জীবন দিলেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাদের ইতিহাস আমাদের জানতে হবে, বুঝতে হবে এভাবেই একদিন আমাদের মাঝে থেকেই জন্ম নেবেন একে একে সব হারিয়ে যাওয়া শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা।