মাদ্রাসায় পড়াশোনা- পর্ব ০১

আমার বয়স যখন ১০ বছর তখন হাফেজি মাদ্রাসা ও এতিমখানায় ভর্তি করে আমার পরিবার।
আমি এতিম ছিলাম না।
সেখানে শুধু এতিম, ভিখারীর ছেলে ও অসচেতন গার্জিয়ানদের বাচ্চারা ছিল।
দেখলাম পায়ে শেকল বাঁধা একটি ছাত্র। নাম ওয়াহিদ।
তার পিতা ভ্যানগাড়ি চালাতো।
তার দোষ ছিল মাদ্রাসায় না পড়তে চাওয়া এবং পালানোর চেষ্টা। প্রতিটা মাদ্রাসায় শেকল বাঁধা ১/২টা বাচ্চা দেখা যেতো।

আমাদের খেলাধুলা করা ছিল নিষিদ্ধ ব্যাপার।
কলার ওয়ালা শার্ট ও গেঞ্জি গায়ে দেয়াও নিষেধ।
অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্নতায় প্রায় প্রতিটা বাচ্চার চর্ম রোগ লেগেই থাকতো। বড় ছাত্ররা জোড় করে ছোটদের যৌন নির্যাতন করতো। মারধোরের কারনে বাচ্চাদের মধ্যে কোন আত্মবিশ্বাস ছিল না, যে কারনে কেউ এসব নিয়ে মুখ খুলতো না।

বেশিরভাগ ছাত্র আমার বয়সি এমনকি ৬/৭ বছর বয়সি ছাত্র ছিল অনেক।
নতুন ছাত্র ভর্তি হলে শুরুতে কান্না করতো বাড়ি যাওয়ার জন্য। পিটানি দিলেও সে কান্না থামতো না।
মাত্র একদিনের মধ্যে কান্না থামানোর বিশেষ কৌশল ছিল হুজুরদের।
নতুন ছাত্রকে কিছু বলতো না, অন্য ছাত্রদের
উড়াধুরা মাইর দিতো। এই মাইর দেখে নতুন ছাত্রদের কান্না অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যেতো।

আমি তাকিয়ে থাকতাম রাস্তার দিকে।
স্কুলের ইউনিফর্ম গায়ে পরা ছেলেমেয়েদের দেখলে মনে হতো ওরাই স্বর্গের ছেলেপেলে। আমরা আছি জেলখানায়।
তখন খুব স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে হতো। একটু স্বাধীনতা ও খেলাধুলার জন্য মনটা ছটফট করতো। জানতাম বাড়িতে আমার ইচ্ছের কোন দাম পাবো না উল্টো মারধরের শিকার হবো।
প্রায় ১ বছর কেটে গেলো।
একদিন সুযোগ বুঝে মাদ্রাসা থেকে পালালাম, নানা বাড়ি। ধরে এনে আবার মাদ্রাসায় দিলো। প্রতিদিন চরম মারধর খেয়ে আমার মানষিক অবস্থার চরম অবনতি হলো। বাড়িতে গিয়ে দশ টাকা, বিশ টাকা, একশো টাকা যা পেতাম ওইটা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম। রাতে কোন মসজিদে গিয়ে ঘুমাতাম। এক দুই দিন পর আবার বাড়ি যেতে হতো ক্ষুধার যন্ত্রনায়। মাদ্রাসা থেকে পালানোর জন্য ও চুরি করার জন্য বাড়িতেও মার খেতাম নিয়মিত।

দুইদিকের চরম নির্যাতনের কারনে একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকা যাবো। এর আগে কখনও ঢাকা যাইনি।
২০০১ সাল। ঢাকা রওয়ানা করলাম।
কার কাছে যাবো কি করবো কিছুই জানিনা।
বাড়ি থেকে ৭০০ টাকা চুরি করে রওয়ানা দিলাম ঢাকায়। বাড়িতে আমার সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না। সবাই ভেবেছে আমি হারিয়ে গেছি। মাইকিং করেও তারা আমার কোন সন্ধান পায়নি। বাড়ির কথা মনে পরলে ভয় পেতাম। তখন অন্তত মারধর খেতে হচ্ছেনা এটাই ছিল সবচেয়ে শান্তির।

সেখানে ১ বছর প্রায় রাস্তায় রাস্তায় বড় হয়েছি। প্রতিটা দিন ছিল আমার জন্য নানান ঘটনাবহুল।
বয়স তখন ১৩ বছর। একদিন কি যেনো মনে করে হঠাৎ বাড়ি চলে আসলাম। অনেক ঘটনা পেরিয়ে আবার আমাকে অন্য মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিল।

শুরু হলো মাদ্রাসার দ্বিতীয় অধ্যায়। চলবে….

Photo credit by BBC

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *