দ্বিতীয় মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার পর আমি হতবাক হয়ে গেলাম।
মাদ্রাসায় শিক্ষক নেই।
হোসাইন নামে একটা ছেলেকে বলৎকারের জন্য শিক্ষকের চাকরি চলে গেছে। সেই ছাত্রকে নিয়েই আবার পাশের মাদানি নগর মাদ্রাসায় নতুন শিক্ষক হিসেবে উনি যোগ দিয়েছেন। বলৎকারের ঘটনা স্বয়ং কমিটির লোকজন জানালা দিয়ে দেখে ফেলেছে।
পাশের থানা কলাপাড়া থেকে হেমায়েত নামের শিক্ষক আমাদের মাদ্রাসায় যোগ দিলেন ২ দিন পর।
তিনি বিভিন্ন বয়ানে বুঝিয়ে দিলেন তার কথা অমান্যকারীকে কখন কি রকম ভয়াবহ শাস্তি দিয়েছেন। এর দুইদিন পর শুরু হলো চরম ধোলাই পর্ব।
একটা ছোট বাচ্চাকে এক হাত দিয়ে শুন্যের ওপর তুলে আরেক হাত দিয়ে বেধরক পেটালেন। সবার কলিজা শুকিয়ে অবস্থা খারাপ।
নতুন হুজুরের পেটানোর ধরনগুলো বর্ননা করা খুব কঠিন। ওনার মন মেজাজ সব সময় গরম ছিলো। ওনাকে কখনও হাসতে দেখিনি। মেজাজ গরমের সময় অকারনেই ছাত্রদের পেটাতেন। যেমন ছুটির টাইম পার হয়ে যাওয়ার পরেও ছুটি দিতেন না। তখন ছাত্ররা বার বার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হুজুরকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন ছুটির সময় হয়েছে। ওঁৎ পেতে থাকা হুজুর তখন বেছে একজনকে ধরে আচ্ছা মত পেটাতেন আর বলতেন তুই ঘড়ির দিকে তাকালেই কি আমি ছুটি দিবো!!
অনেকেই বলে মাদ্রাসার ছাত্ররা ভারি দুষ্ট হয়। আসলে এর পেছনে অনেক কারন রয়েছে। একই হলরুমে পাশাপাশি অনেক ছাত্র থাকলেও তাদের মধ্যে কথা হতো খুব কম। সারাদিন সাউন্ড করে পড়াশোনার মধ্যে অবসর বলতে কোন সময় ছিল না। বিনোদনের কোন ব্যাবস্থা ছিল না। খাওয়ার সময়ও কোন কথা হতো না, সেটা ছিল আদবের বরখেলাপ। দিনে ঘুমানোর সময় কোন ছাত্র কাশি দেয়ার আগেও ভেবে নিতো। কারো তিল পরিমান এদিক ওদিক হলে ছাত্ররাই হুজুরের কাছে নালিশ দিতো।
ছবক না দিতে পারা, এদিক ওদিক তাকানো সহ প্রতিদিনই প্রায় মার খেতে থাকলাম। সারাদিন ভয়ের মধ্যে ও কঠোর নিয়ম কানুনে আবার বন্দী হয়ে গেলাম। একদিন ব্যাডমিন্টন খেলার অপরাধে আমাকে মারতে মারতে সারা শরীর যখম করে ফেললো। ভাবলাম এবার ছুটিতে বাড়ি গিয়ে সব বলবো।
তিন মাস পর ৩ দিনের ছুটিতে বাড়ি গেলাম। ফুফুকে বললাম সব ঘটনা। আমার শরীরে মারের দাগগুলো দেখালাম। মা-বাবাকে বলার সাহস ছিল না। ফুফু মায়ের কাছে কাঁদতে কাঁদতে বললো কিছু ঘটনা। এরপর শুরু হলো উল্টো রিয়্যাকশন। আমি নাকি হুজুরের নামে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলি এবং হুজুর যদি মেরেও থাকে সেই যায়গা জান্নাতে যাবে।
ছুটি শেষে মাদ্রাসায় দিয়ে আসার সময় হুজুরকে বলে আসলো আমাকে যেনো আর ছুটি না দেয়া হয়। আমি বাড়ি গিয়ে হুজুরের নামে বদনাম করি। আমার শরীরে মাংস চায় না তারা, শুধু হাড্ডি দিলেই হবে। আমাকে মাদ্রাসায় রেখে যাওয়ার ৫ মিনিট পরেই শুরু হলো আমার ওপর নির্মম নির্যাতন। ঠিক যতগুলো বেতের বাড়ি দিলে একটা বাচ্চা ছেলে মরে না যায় ততগুলো বারি আমার শরীরে পরেছিলো। পরেরদিন কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসলো।
একদিন খুব সকালে নামাজের পর এক ছাত্রকে হুজুর ডাকলেন। কি যেনো বলার পরেই মারতে শুরু করলেন। থেমে থেমে ৪ ঘন্টা পেটালেন। সকাল ৬ টা থেকে শুরু করে ১০ টা পর্যন্ত। সেদিন সবার পড়াশোনা অফ করে শুধু মারের দৃশ্য দেখলো ছাত্ররা। সবাই বুঝতে পারলো বিশাল কোন অপরাধ ঘটে গেছে। কোন ঘটনায় পড়া অফ থাকেনা, কিন্তু এই ঘটনায় পড়াশোনাও অফ। সাধারন কোন ছাত্ররা জানেনা ছেলেটার অপরাধ কি! কমিটির লোক আসলো। ছাত্রটাকে বিদায় করে দেয়া হলো। পরে সবাই জানতে পারলাম ছাত্রটা গভীর রাতে একটা পাগলীকে আকাম করেছে। ঘটনা দেখে ফেলেছে পাশের মসজিদের হুজুর।
প্রতিটা ছাত্রকে মারধর করার সময় আমার ছোট হৃদয় কেঁপে উঠতো। সমান ব্যাথা আমি অনুভব করতাম। খুব কম বয়স থেকেই নিজের মৃত্যু কামনা করতাম। সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকলাম। আমাকে পালাতে হবে। আমি এখানের লোক নই। আমি জেল থেকে পালাতে চাই।
চলবে….
Photo credit by BBC