মাদ্রাসায় পড়াশোনা- পর্ব ০৩

অনেকের বাবা-মা সন্তানকে দেখতে প্রতি মাসে মাদ্রাসায় আসতো। কেউ ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যেতো, আবার কেউ খাবার কিনে দিয়ে চলে যেতো। রেখে যাওয়া ছাত্রদের গোপনে কাঁদতে দেখেতাম। প্রকাশ্যে কান্না করলে হুজুর মারতো।
আমার গার্জিয়ান আমাকে দেখতে কখনও মাদ্রাসায় আসেনি। ভর্তি সহ সবকিছু অন্যকে দিয়ে করিয়েছিলো।
অন্ধ এক ভিখারী লোক একদিন তার সন্তানের খোঁজ নিতে এসে অনেক কান্না করলো। ছেলেটাও তার বাবাকে ধরে কাঁদলো। বললো বাবা আমাকে নিয়ে যাও। ছেলেকে না নিয়েই অন্ধ বাবা চলে গেলো আর বলে গেলো তোমাকে আমি ভাল মানুষ করতে পারবো না, তুমি এখানেই থাকো।
জড়িয়ে ধরে সেই কান্না- আমার দেখা সুন্দর দৃশ্যগুলির মধ্যে ছিল অন্যতম। কিন্তু এই কান্না করা এবং বাড়ি যেতে চাওয়ার কারনে মার খেতে হয়েছিল ছেলেটাকে।

হঠাৎ এক বিকেলে আমার বাবা তার মোটরসাইকেল নিয়ে মাদ্রাসায় হাজির। কারন আমি লোক মারফতে খবর পাঠিয়েছিলাম, আমার পাঞ্জাবি মাত্র একটা। সেটা ধূয়ে দিলে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে পরে থাকতে হয়। নামাজ ও কোরান শরীফ পড়ার সময় গায়ে পাঞ্জাবী না থাকলে হুজুর মারে।
বাবা আমাকে বাইকে নিয়ে পাঞ্জাবীর মাপ দিয়ে মাদ্রাসায় রেখে চলে গেলো। সবাই অবাক! তখনকার সময়ে কারো পার্সোনাল বাইক মানে বিশাল ব্যাপার। হুজুরও আশ্চর্য হয়ে গেলো। আমি ওমোক বাড়ির ওমোকের ছেলে অথচ সে ভাবতো আমি কোন দিনমজুর বা খুব নিম্নবিত্ত লোকের ছেলে।

মাদ্রাসায় লিল্লাহ বোডিং ছিল।
কেউ অর্ধেক বেতন দিতো আবার কেউ পুরোটা। একদম গরীব ও এতিমদের জন্য বেতন ফ্রি। যারা বেতন কম দিতো বা ফ্রি থাকতো, তাদের দিয়ে ভিক্ষা করানো হতো।
মোটামুটি মাদ্রাসার সবাই ছিল গরীবদের সন্তান।
কেউ ফুল বেতন দিতো না,
তাই সবাই যেতো ভিক্ষা করতে।
নতুন ধান ওঠার পর গ্রামে গ্রামে গিয়ে ধান ভিক্ষা করার জন্য ছাত্রদের দূর দূরান্তে পাঠিয়ে দেয়া হতো। মাদ্রাসা পাহাড়া সহ কিছু ছাত্রদের রেখে দেয়া হতো।

ভিক্ষা ওঠানোর জন্য এলাকা ভাগ করে হুজুর নাম ডাকতেছে। একদম শেষে এসে দেখি আমার নাম ডাকেনি। মন খারাপ হয়ে গেলো। মাদ্রাসায় থাকার চেয়ে আমার কাছে ভিক্ষা করা অনেক আনন্দের ছিলো। যদিও এই ভিক্ষা ওঠানোর নাম ছিল চাঁদা ওঠানো।

বললাম হুজুর, চাঁদা ওঠাতে আমিও যাবো । এরপর শুরু হলো আমার নিয়মিত ভিক্ষা করা। মার খাওয়া থেকে দূরে থাকার যেকোন অপশনই আমার ভাল লাগতো। আমরা তিনজন ছাত্র গেলাম গ্রামে ধান ভিক্ষা করতে৷ নজমুল নামক ছাত্রদের বাড়ি ধান এনে জমা করতাম এবং রাতে থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা সেখানেই। মাদ্রাসার প্রতিদিনের চাল সহ কাঁচা বাজার সব ছিল ভিক্ষা করা। বাজারে গিয়ে ডাকে ওঠা মাছ থেকে দু একটা মাছ ভিক্ষা চেয়ে চেয়ে আনতাম।

Photo credit by BBC

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *