মরা বাড়িতে কোরান খতমের জন্য মাদ্রাসা ছাত্রদের ভাড়া করা হতো। প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহে কয়েকটা মরা বাড়ি কোরান খতমের প্রোগ্রাম আসতো। কোরান খতমের পর বখশিশ দেয়া হতো। কোরান যাদের বেশি পারা মুখস্ত তাদেরকেই পাঠানো হতো খতমের জন্য। একদিন হুজুর আমাকেও যেতে বললো। আমি তো মহা খুশি, কিছু টাকা পাওয়া যাবে। মরা বাড়ি থেকে জনপ্রতি ১০০ টাকা করে দিলে মাদ্রাসায় আসার পর হুজুর ৫০ করে রেখে দিতেন। তাতেও আমরা খুশি।
হুজুর হঠাৎ করে সিনিয়র ছাত্র রেখে আমাকে কেনো কোরান খতমে পাঠালেন সেটাই তখন বুঝতে পারলাম না।
অনেকে জানেনা মাছ এবং তরকারী ভিক্ষা করা যায়। মজার ব্যাপার হলো আমাদের মাদ্রাসায় প্রতিদিন ভিক্ষা করা তরকারী এবং মাছ দিয়েই সব ছাত্রের মিল হয়ে যেতো। খুব সকালে মাছ বিক্রেতার সামনে ব্যাগটা খুলে একটা হাসি দিলেই চেহারা দেখে বুঝে যেতো এরা মাদ্রাসার লোক। কেউ বলতো আজ ছোট মাছ নাই আবার কেউ ২/৩/৫ টা চিংড়ি কিংবা ছোট মাছ ব্যাগের মধ্যে ফিক দিতো। সবজির বাজারেও সেইম প্রসেস। অর্ধেক পঁচা সবজি, বাসি সবজি ফেলে না দিয়ে ওগুলো সব ব্যাগে দিয়ে সবাই সোয়াব কামাই করতো।
প্রত্যেক মাদ্রাসায় একজন করে খাদেম থাকে। তার কাজ রান্না করা এবং চাঁদা আদায় করা। চাঁদার পরিমান বেশি হলে খাদেম এবং আদায়কারী হিসেবে ২জন রাখা হতো।
সাপ্তাহিক হাটবারের দিন রসিদ নিয়ে হাটে বাজারে ঘুরে বেড়াতাম। প্রত্যেক টিমে ২জন করে থাকতাম। ছোট বড় সব ব্যাবসায়ীর কাছে টাকা চাইতাম।
স্যুট প্যান্ট পরা ভদ্রলোক দেখলেও টাকা চাইতাম (ওমোক মাদ্রাসা লিল্লাহ বোডিং ও এতিম খানায় কিছু দ্যান)। শার্ট-প্যান্ট পরা মানুষদের কাছে টাকা চাইতাম কেউ দিতো আবার কেউ দিতোনা, কিন্তু কখনও হুজুর দেখলে টাকা চাইতাম না। সাধারানত হুজুরেরা দান করার কথা বললেও নিজেরা দান করেনা।
যারা অরিজিনাল ভিক্ষুক তাদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করলেও আমাদের সাথে কেউ খারাপ ব্যাবহার করতো না, কারন আমরা তালবেআলিম। আমাদের হাটার রাস্তায় ফেরেস্তারা নূরের পালক বিছায়া দেয়। তাদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করে নিশ্চই কেউ পাপের ভাগি হবে না। প্রথম প্রথম সব টাকা তুলে দিতাম হুজুরের কাছে। কিছুদিন পরে বুঝলাম সবাই টাকা কালেকশন করে এইটা ওইটা খায়, জমা দেয়ার আগে নিজেও কিছু রেখে দেয়।
চাঁদার পরিমান বেশি উঠলে হুজুর ১০/২০ টাকা করে বখশিশ দিতেন। কালেকশনের পর সন্ধ্যায় জানিয়ে দেয়া হতো আজ কে কম এবং বেশি টাকা দিয়েছে। যারা কম কালেকশন দিতো তাদের বাদ দিয়ে পরের সপ্তাহে সেখানে ভিন্ন লোক দিতো। হুজুর ছিল বড়ই বুদ্ধিমান, কে টাকা মেরে খায় এবং কত টাকা খায় এটা চোখ দেখেই বুঝে যেতো।
বেশি টাকা মেরে খাওয়া টিমের লোক বদল করে দিতো। এতে করে বন্ডিং হতেও সময় লাগে। একজন টাকা মেরে খাইলে আরেকজন বলে দেয়।
ডাক বাংলায় এক চেয়ারম্যান বসতেন। তিনি যে হাটবার অফিসে উপস্থিত থাকতেন সে বার কমপক্ষে ৫০০ টাকা দান করতেন, এটা মাদ্রাসার সবাই জানে। প্রত্যেকবার রসিদে নিজ হাতে দুই সাইডেই টাকার পরিমান লিখে দিতেন এবং অর্ধেক ছিড়ে রাখতেন। তার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে বের হলাম। আমার পার্টনার সাইফুলকে বললাম চল, আজ লঞ্চে ভিসিআরে ছবি দেখবো। তখন ঢাকা যাওয়ার লঞ্চে তুমুল প্রতিযোগিতা চলতো। ঘাটে সব সময় একের অধিক লঞ্চ দেখা যেতো। প্রত্যেকেই ভিসিআরে ছবি ছেড়ে রাখতো, যাত্রীদের আকৃষ্ট করার জন্য। হাফ বেলায় ভালই কালেকশন হয়েছে। আমরা দুপুরে ভরপেট খাইলাম হোটেলে। বিকেল ৪টায় লঞ্চ ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত সিনেমা দেখলাম। আরো কিছু সময় কালেকশন করে দেখলাম আজ টাকা অনেক কম। তার ওপর চেয়ারম্যান দিয়েছে ৫০০। আমরা তাহলে সারাদিন কি করছি এটা হুজুর বুঝে যাবে রসিদ দেখলেই। আমি চেয়ারম্যানের ৫০০ টাকার যায়গায় ৫০ লিখেছি কাটাকাটি করে।
রাত ৯টা। মনের মধ্যে ভয় চলতে থাকলো। যদি কোনভাবে হুজুর জেনে যায় তবে কেয়ামত হয়ে যাবে। কালেকশনের হিসাব পর্ব আজ দেড়ীতে হচ্ছে। রসিদ দেখতে দেখতে হঠাৎ হুজুর বললেন আজ পুরান হাসপাতাল ও লঞ্চঘাট কে কে গিয়েছিলো? আমার পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো। আমাকে কাছে ডাকলেন, জিজ্ঞেস করলেন এই চেয়ারম্যান কি সত্যিই ৫০টাকা দিছে? এর আগে তো কোনদিন উনি এত কম টাকা দেয়নি। কোন এক অজানা কারনে হুজুর বুঝেও আমাকে কিছু বললেন না, আরোও ২০ টাকা বখশিশ দিলেন।
ইদানিং আমি ছবক দিতে না পারলেও হুজুর আমাকে কিছু বলে না। আমিও সেই সুযোগ কাজে লাগাতাম। অলরেডী আমার ১০ পারার মত কোরান মুখস্ত হয়ে গেছে। আমি আবার ১পারা পিছনে চলে গেলাম। ৯পারা থেকে ছবক দেয়া শুরু করলাম। মনে আনন্দ, নতুন করে অনেকদিন আর মুখস্ত করতে হবে না। হুজুর প্রথম দিনই ধরে ফেললেন, বললেন আগেও তো এই ছবক দিছো। আমি বললাম না হুজুর, আমি ৯পারা পর্যন্তই ছবক দিয়েছি। তিনি আর কিছু বললেন না।
আমার মনের মধ্যে শংকা তৈরী হতে লাগলো। হুজুর কেনো আমাকে কিছু বলছে না!
চলবে…
Photo credit by BBC