স্মৃতিচারণ

মাদ্রাসা থেকে বের হওয়ার পর বাবা-মায়ের ঘরে আমার জায়গা হয়নি। স্কুলে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে অনেক নির্যাতন সহ্য করে মাদ্রাসা ত্যাগ করেছিলাম।
ততোদিনে আমার নিজের ঘর-বাড়ি অপরিচিত হয়ে উঠেছে। পরিবারের সদস্য থেকে প্রকৃতি আমার নাম কেটে দিয়েছে।
আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে ঘুরতে থাকলাম। বাবা-মা ছাড়া কোন আত্মীয় নিজের মনে হয়নি। তারাও আমাকে প্রচন্ড অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে। মহা অন্যায় ও অপমান নিয়ে বেশিদিন টিকতে পারিনি।

কিভাবে স্কুলে ভর্তি হবো, কার কাছে যাবো, বই কেনার টাকা কই পাবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। যারা ছোটবেলায় কাজ করে পড়াশোনা করতে পারে আমি তাদের মতো ততোটা সাহসী ছিলাম না। নির্যাতনের কারনে আমার মানসিক গ্রোথ খুব ধীর ছিল। প্রচন্ড রকমের ভিতু ছিলাম।

এর আগে আমি মাদ্রাসা পালিয়ে ১ বছর ঢাকায় ছিলাম, তখন যে কাজ করেছি ঢাকাতে, সেই কাজ ছিল খুবই মর্মান্তিক। সদর ঘাটের চারতলা মসজিদের সামনের সাইকেল মাঠে ভ্যান গাড়িতে ভাত বিক্রি করতাম। সিনেমার মতো কাঁচামালের ভ্যানগাড়িও ঠেলেছি। এসবের মধ্যে হয়তো কোন কষ্ট থাকতো না যদি পরিবার অস্বচ্ছল থাকতো। তবুও করতে পেড়েছি মাদ্রাসার নির্যাতনের ভয়ে।
এখন নিজেকে স্কুলের ছাত্র ভাবতেছি তাই এইসব কাজ করতে মনে চায়না। আর কাজ করে স্কুল যাওয়ার মত সুযোগ তখন ছিল কল্পনাতীত।

আবার বাড়িতে চলে আসলাম, দাদীর ঘরে উঠলাম। দাদা-দাদী রাগ করলেও আমি তাদের ঘরেই থাকতে শুরু করলাম। বাড়িতে প্রচূর লেবু গাছ ও সুপারি গাছ ছিল। চুরি করে এসব বিক্রি করে টাকা জমিয়ে বই কিনলাম। স্কুলেও ভর্তি হলাম ক্লাস সিক্সে। ততোদিনে আমি চারবছর পেছনে পরেছি পড়াশোনায়।
দাদা দাদীর কোন ইনকাম ছিল না, আমার বাবার ওপর নির্ভরশীল ছিল। বাবার সাথে যেনো দেখা হয়ে না যায় এজন্য খুব শতর্ক থাকতাম। সে একবার বাড়ি থেকে সকালে বের হয়ে গেলে কখনই রাত ১২ টার আগে আর বাড়িতে ফিরতেন না।

একদিন রাতে তিনি মদ খেয়ে বাড়িতে এসে প্রচন্ড রকমের মাতলামি শুরু করলেন। মাকে মারধোর করার পরে, দাদীর ঘরে গিয়ে আমাকে খুঁজতে লাগলেন। ততোক্ষনে আমি বাড়ির পেছনের বাগানে লুকিয়ে গেলাম। দাদা-দাদীকে চরম থ্রেট দিয়ে বললেন আমাকে আশ্রয় দিলে তাদের ভরনপোষণ বন্ধ করে দিবে সামনের কাল থেকেই। আমার পড়ার টেবিল ভেঙে দিয়ে বই পত্র ছিড়ে ফেলে দিলেন।
আমি ভয়ে দূরে বাগানে গিয়ে বসে ছিলাম। মনে দুঃখ পাওয়ার চেয়ে মশার কামড়ে বেশি যন্ত্রনা হচ্ছিলো।

আমার তখন ভালবাসা স্নেহের চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় ছিল জরুরী। যে বয়সে ক্ষুধার যন্ত্রনা থাকার কথা সেই বয়সে দুঃখ ব্যাথার যন্ত্রণা নিয়ে সময় কাটছিলো আমার। দূর্বল হৃদয় নিয়ে আমি বড় হয়েছি। আমি সবার মত স্বাভাবিক লোক নই। পকেটমার ও চোর ডাকাত ধরা পরলে সবাই পিটুনি দেয় আর সে দৃশ্য দেখে বাকিরা খুশি হয়, অথচ আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। সম পরিমান ব্যাথা আমি তীব্র ভাবে অনুভব করি। পিটুনি খাওয়া লোকদের আমার খুব আপন মনে হয়। কোথাও কোন লাশ দেখলে আমার দিনটি খারাপ যায়, মনে হয় লাশটা আমার। পাশে আত্মীয় স্বজনের কান্না যেনো আমারই কান্না। নিজের লাশ নিয়ে নিজেই কাঁদছি।

(মার্চ ১০, ২০১৮, ডায়েরি নং ৪, কাশিমপুর কারাগার)