শাহরিয়ার কবির আসলেই মুরগি সাপ্লাইয়ার?

“বাংলাদেশ আজ পাকিস্তানের সাথে থাকলেই ভাল হতো” বলা লোকজন শাহরিয়ার কবিরকে ঘৃনা করে। অথচ তাদের তো ওনাকে ভালবাসার কথা।

দেশ স্বাধীনের সময় হয়তো মানুষ
হত্যার চেয়ে মুরগি সাপ্লাই দেয়া বেশি অপরাধ ছিলো! এজন্যই হয়তো সাধারন মানুষ নিজামী আর সাঈদীকে আপন ভাবে আর শাহরিয়ার কবিরকে ঘৃনা করে।

“পাকিস্তানিদের মুরগি সাপ্লাই দিতো শাহরিয়ার কবির” এই তত্ত্বটি নুরু গ্রুপ থেকে শুরু করে ওয়াজের মাঠ ভায়া বাঁশেরকেল্লা – সর্বত্রই ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যারা ছড়িয়েছে তারা জঙ্গী সমর্থক, তারা স্বাধীনতা বিরোধী।

আমাদের দেশে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে “মুরগি চোরা শাহরিয়ার কবির” বানানো খুবই সহজ। কোন বিখ্যাত লোককে যদি খুবই ছোট বিষয় নিয়া তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা অথবা চরিত্র নিয়া কথা বলা যায় তহলে অতি সহজেই সামাজিকভাবে সবাই মিলে অর্গাজমের সুখ নেওয়ার নেকী হাসিল করে। যেমন মমতাজ বেগমকে দুই টাকার বে শ্যা বলা।

মানুষ এমনভাবে মমতাজ বেগমকে বে শ্যা বলে যেনো সে নিজে টাকা দিয়ে মমতাজকে ভাড়া করে তার বাপের কাছে শুইয়ে দিয়েছে। তাদের কাছ থেকে শুনলে মনে হবে মমতাজের একমাত্র কাজই শুইয়ে বেড়ানো।

মুরগী কবির ডাকা লোকজন শহরিয়া কবিরের বই পড়া তো দূরের কথা এরা আউট অফ এক বই অথবা সিলেবাসের বাইরে কোনদিন যায়নি।

জঙ্গিবাদ নিয়ে শাহরিয়ার কবিরের মতো এত বিস্তৃত গবেষণা বোধহয় বিশ্বের খুব কম মানুষেরই আছে।

হারুন জুয়েল ভাই একটা কথা বলেছিলেন- “শাহরিয়ার কবির, শামসুর রহমান, জাহানারা ইমাম, জাফর ইকবাল প্রত্যেকের চরিত্র হননের চেষ্টা চলেছে। প্রজন্মকে প্রতিক্রিয়াশীল বানাতে এরচেয়ে যে আর ভালো কোনো উপায় নেই।”

আমার সঙ্গে কখনো দেখা না হলেও এই লোকটির মেধা, শ্রম ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামকে আমি শ্রদ্ধা করি। বিভিন্ন হামলা মামলায় জর্জরিত হয়ে দীর্ঘ সংগ্রাম করা ব্যক্তিটির চরিত্র হনন করা হয়, আমরা কিছুই করতে পারি না!
শাহরিয়ার কবির রাজাকার ছিলেন এর সূত্র কি? মামুনুল হকের মতো অনেকেই বলবে, “কাদের সিদ্দিকী নিজে বলেছেন শাহরিয়ার কবির পাকিস্তানিদের মুরগি সাপ্লাই দিতো”।
কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্য আবার শুনুন। সেই বক্তব্যে কাদের সিদ্দিকী মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালকে ফায়দা লাভের বিচার বলে উল্লেখ করে বলেন, “রাজাকারের বিচার নিয়ে আমি বললে অপরাধ হয় আর ঐ শাহরিয়ার কবির বললে প্রশংসা হয়, রাজাকার বললে প্রশংসা আমি বললে অপরাধ?”

দিগন্ত টিভি ছাড়ার পর কাদের সিদ্দিকীই বলেছিলেন জামাতের সঙ্গে স্বর্গেও যাবে না। শাহরিয়ার কবির সম্পর্কে কাদের সিদ্দিকীর সূত্র হচ্ছে বাঁশেরকেল্লার প্রচারণা – শহীদজায়া মুশতারী শফী নাকি লিখেছেন শাহরিয়ার কবির মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের মুরগি সাপ্লাই দিতেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুশতারী শফী ছিলেন চট্টগ্রামে। তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গবেষণাও চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক। কাদের সিদ্দিকী ছিলেন টাঙ্গাইলে। শাহরিয়ার কবির ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কারো সঙ্গে কারো যোগাযোগের কোনো সূত্র নেই।


শাহরিয়ার কবির ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম প্রকাশনাগুলো প্রকাশিত হয়েছিল কোলকাতা থেকে। সেই প্রকাশনাগুলোর একটি শাহরিয়ার কবিরের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস “পূবের সূর্য”।
৭২ সালের মে মাস থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিচিত্রার অন্যতম উদ্যোক্তা ও সহকারী সম্পাদক ছিলেন তিনি। যার প্রতিটি পদক্ষেপের তথ্য রয়েছে তার মতো একজন ব্যক্তিকে রাজাকার বলা কাদের পক্ষে সম্ভব?


প্রচারিত হয় যে, শহীদজায়া মুশতারী শফীর “বেগম জাহানারা ইমামের স্মৃতির উদ্দেশ্যে লেখা চিঠি” নামের বইয়ে উল্লেখ রয়েছে যে, শাহরিয়ার কবির পাকিস্তানিদের মুরগি সাপ্লাই দিতেন। মুশতারী শফীর মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গ্রন্থের নাম “মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী”। 
মুশতারী শফী এবং শাহরিয়ার কবির দুজনই ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম নেতা ছিলেন। মুশতারী শফী কি একজন রাজাকারের সঙ্গে আন্দোলন করেছেন?
যে বইয়ের সূত্রে অপপ্রচার চলে সেটির নাম “চিঠি, জাহানারা ইমামকে”। এটি তার কর্মজীবন, বিশেষত নির্মূল কমিটির দ্বন্দ্ব সংশ্লিষ্ট। জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর মুশতারী শফী নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক হয়েছিলেন। কিন্তু কবীর চৌধুরী, শওকত ওসমান ও হাসান ইমাম সহ বেশিরভাগ নেতাকর্মীরা শাহরিয়ার কবিরকে যোগ্য মনে করতেন। মূলত এই ভুল বোঝাবুঝিই সেই অসমাপ্ত সামাজিক আন্দোলন হিসেবে উল্লেখ করা “চিঠি, জাহানারা ইমামকে” বইয়ের উপজীব্য।


ব্যক্তিগতভাবে পরিচয় থাকলে হয়তো আরও কিছু তথ্য দিতে পারতাম। স্বল্প জ্ঞানে যা বুঝি, জঙ্গিবাদ নিয়ে শাহরিয়ার কবিরের মতো এত বিস্তৃত গবেষণা বোধহয় বিশ্বের খুব কম মানুষেরই আছে। 
তাঁর ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা হতেই পার ।

মেধা ও মানবতার সাধনা করেন, তাই তাকে আওয়ামী লীগার হিসেবে বিবেচনা করাও সঠিক নয় বলে মনে করি।
সবচেয়ে বড় কথা, শাহরিয়ার কবিরের মতো আজন্ম সংগ্রামী একজন মানুষকে নিয়ে বিতর্ক তোলা অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত।